প্রকাশিত: Sun, Jan 21, 2024 12:10 AM
আপডেট: Thu, Jun 26, 2025 7:45 PM

[১]চট্টগ্রামে গ্যাস সংকটে প্রভাব পড়েছে গৃহ থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে

[১]রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে তীব্র গ্যাস সংকটে জ্বলছে না চুলা

মাসুদ আলম: [২] এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ক্রটি ও শীতের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না কোনও কোনও এলাকায়। 

[৩] মিরপুরের একজন গৃহিনী গ্যাস সংকটের বর্ণনা করেন এভাবে, “ভোর পাঁচটা বাজে উইঠা দেখি যে একটু পানিও গরম করতে পারি না। সারাদিন তো গ্যাস আসেই না। সকাল বেলা নাস্তা বানাইতে পারি না ছেলে অফিসে যায়। ছেলের বাপ ডায়েবেটিসের রোগী, তারে নাস্তা বানায় খাওয়াইতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়,” । 

[৪] ভাটারা নুরেরচালার বাসিন্দা তাসলিমা বেগম মলি বলেন,  শীত শুরুর পর থেকে দিনের বেলায় সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ কমে যেত। মিট মিট করে জ্বলা চুলায় রান্না হত না। সপ্তাহ খানেক ধরে  সকাল ৭টায় গ্যাস সম্পূর্ণ চলে যাচ্ছে, আসছে ঠিক রাতের ১০ থেকে ১১টার দিকে। তাই বাধ্য হয়ে রাইস কুকারে রান্না করতে হচ্ছে। 

[৫] একই অবস্থা  উত্তর বাড্ডা এলাকার। সেখানকার বাসিন্দা সাবানা আক্তার বলেন,  কয়েকদিন ধরে চুলায় গ্যাস আসছে না। বিকল্প উপায়ে রান্না করতে হচ্ছে। 

[৬] দক্ষিণখানের বাসিন্দা হিরা আক্তার বলেন, এই এলাকায় র্দীঘদিন ধরে গ্যাসের সংকট চলছে। তার মধ্যে গত তিন মাস ধরে সকাল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত আসে না। গভীর রাতে গ্যাস আসে। 

[৭] গ্যাস সংকট সম্পর্কে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে টার্মিনালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। 

[৯] শনিবার সকালে কেজিডিসিএল এর মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে বিশেষজ্ঞ টিম এসেছে ত্রুটি সমাধানের কাজ করছে। এর মধ্যে কিছু জায়গায় গ্যাস সরবরাহ শুরুও হয়েছে। তবে চাপ কম।

 [১০] সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, চলমান গ্যাস সংকট সাময়িক। এটা কমিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে। আগামী মার্চ থেকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। সম্পাদনা: ইকবাল খান

ইকবাল খান:  [২] “চুলায় কিছুটা গ্যাস পাওয়া যায় রাতে তিনটা-চারটার দিকে। গত কয়েকমাস ধরে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ঐ অল্প গ্যাসে কোনোরকমে সকালের নাস্তা তৈরি করি। গত দু’দিন ধরে সেই সামান্য গ্যাসও আসছে না।” 

[৩] বিবিসি জানায়, চট্টগ্রাম শহরের হাজার হাজার মানুষের দিনযাপনের গল্পটা ফিরিঙ্গি বাজারের বাসিন্দা ননী ঘোষের মতই। নিয়মিত গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় পরিবারের সদস্যদের জন্য খাবারের যোগান দিতেই বিপাকে পড়ছে তার মত হাজারো গৃহিণী।

[৪] চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের এই বেহাল পরিস্থিতির শুরু হয় গত নভেম্বর থেকে। সেসময় থেকে গ্যাস সংকট চললেও দিনের কোনো না কোনো সময় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল। তবে গত দু’দিন একেবারেই বন্ধ ছিল গ্যাস সরবরাহ। 

[৫] গ্যাস সংকটে চট্টগ্রামের মানুষের যে শুধু খাবার জোগাড়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তা নয়। বাসাবাড়ির পাশাপাশি গ্যাস পাম্পেও গ্যাস ছিল না গত দু’দিন ধরে। সিএনজি চালিত অটোরিকশা সহ বহু গাড়িকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত গ্যাস পাম্পের বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

[৬] টাইগার পাস এলাকার ইন্ট্রাকো ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার আবদুর রহমান বিবিসিকে বলেন, দু’দিন ধরে তাদের পাম্প বন্ধ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় নভেম্বর মাস থেকেই সীমিত পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়েছে তাদের।

[৭] “গত দুই মাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে না বললেই চলে, যার ফলে যানবাহনে গ্যাস দেয়া সম্ভব হয় না। তারপর নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত গ্যাস দেয়া বন্ধ রাখতে হয়। রাত এগারোটার পর কিছুটা ব্যবসা করতে পারি আমরা।”

[৮] তিনি আরও জানান, গত দুই মাস ধরে লোকসান দিয়েই ব্যবসা চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরকম পরিস্থিতি আরো কিছুদিন চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইয়ে বাধ্য হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আবদুর রহমান।

[৯] গ্যাস স্টেশনগুলোর মত কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে গ্যাস নির্ভর অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানেও। কারণ দেশের অন্যান্য জায়গার মত চট্টগ্রামেও গার্মেন্টস, সার কারখানা, স্টিল মিলসের মত প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন গ্যাসের নিয়মিত ওপর নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় এসব কারখানায় নিয়মিত কার্যক্রম উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

[১০] চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, গ্যাসের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকা শিল্প খাতকে বহুমুখী ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

[১১] “নভেম্বর থেকে গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় শিল্প কারখানাগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। বড় ধরনের ফ্যাক্টরিগুলোর মেশিনগুলো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানিতে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করা হয়। সেই পরিমাণ জ্বালানি না পাওয়া গেলে উৎপাদন তো কমেই, মেশিনেও ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়।”

[১২] আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গার্মেন্টসের মত রপ্তানি পণ্য তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ না হলে তারা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সময়মত অর্ডার সাপ্লাই করতে পারে না। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আবার ক্রেতারাও অনেক সময় ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

[১৩] এরকম পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে কর্মী ছাঁটাই করা ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে পথ থাকবে না বলে বলছিলেন মাহফুজুল হক শাহ।

[১৪] সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। আর দৈনিক সরবরাহ করা হয় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

[১৫] এর মধ্যে ৯০০ থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসতো মহেশখালির দু’টি ভাসমান টার্মিনাল থেকে, যেগুলো আমদানিকৃত এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) প্রক্রিয়াজাত করে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করতো। ২০১৮ সালে এই দুটি টার্মিনাল কার্যকর হয়।

[১৬] গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই টার্মিনাল দু’টির একটি নভেম্বরে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সে কারণে নভেম্বর মাস থেকে চট্টগ্রামে গ্যাসের সরবরাহে সংকট দেখা দেয়।

[১৭] আর বুধবার মহেশখালিতে অবস্থিত দ্বিতীয় টার্মিনাল থেকেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়লে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়।

[১৮] তবে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষে সিঙ্গাপুর থেকে একটি টার্মিনাল এরই মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে আর মহেশখালির দ্বিতীয় টার্মিনালটিও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানা গেছে।